স্প্যানিশ বিপ্লবের মুক্ত নারীরা

« The free women of the Spanish Revolution »

স্প্যানিশ বিপ্লবের মুক্ত নারীরা

“আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা যেন ছিল ভাই-বোনের মতো। এদেশের পুরুষরা নারীদের কখনোই পূর্ণ মানবাধিকারসম্পন্ন মানুষ হিসাবে গণ্য করেনি। আর এই ব্যাপারটাতে আমি সব সময়ই বিরক্ত হতাম। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে একটা বিশাল পরিবর্তন। আমার মনে হয়, এই পরিবর্তন স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসেছে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রভাবে।”
—রোনাল্ড ফ্রেজারের লেখা ‘দ্য ব্লাড অব স্পেইন’ বইয়ে মার্গোরিতা বালাগারের উক্তি

১৯২০ ও ৩০-এর দশকে স্পেনের কৃষক-শ্রমিকদের অবস্থা ছিল বেশ খারাপ। আর নারীদের জন্য তা ছিল  রীতিমতো ভয়াবহ! স্প্যানিশ নারীর প্রতি সেই সমাজ ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ের দমনীয় ও অত্যাচারী। ১৯৩০-এর দশকের স্পেনের নারীদের পরিস্থিতির সঙ্গে এখনকার বেশিরভাগ মুসলিম মৌলবাদী দেশের নারীদের পরিস্থিতির মিল পাওয়া যেতে পারে। সেসময় নারীদের কোনো প্রকার স্বাধীনতা ছিল না। “বিয়ে ঠিক করার” মাধ্যমে তাদেরকে আরেকজনের কাছে সঁপে দেওয়া হতো। অবিবাহিত নারী কখনই কোনো পুরুষ সঙ্গী ছাড়া একা বের হতে পারতেন না।

একজন সাধারণ পুরুষ কৃষকের এক দিনের গড় মজুরি ছিল ৩ পেসেটা। অথচ ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, সারাদিন কাজ করেও একজন নারীর জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ১.৫ পেসেটা! বিভিন্ন সময়ে সংস্কারের নামে যা করা হয়েছিল, সেগুলো নারীদের তেমন উপকারে আসেনি। যেমন, ১৯৩১ সালে রিপাবলিকান সরকার যখন ‘আটঘন্টা কর্মদিবসের’ আইন পাশ করে, তখন তার অর্থ ছিল: বিকেল ৫টার সময় বাসায় ফিরে নারীরা যেন সংসারের সব কাজকর্মও দেখতে পারেন!

১৯৩১-এর সরকার লিমিটেড ডিভোর্সের প্রথা চালু করে। নারীদের ভোটাধিকার এবং অল্প সময়ের মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া শুরু করে। সেসময় স্পেনে যেসব ছোট ছোট নারীবাদী আন্দোলন দেখা যেত, তার বেশিরভাগই ছিল সংস্কারমূলক এবং মধ্যবিত্ত ও চাকুরীজীবি নারীদের উপর ভিত্তি করে। নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনগুলোর মধ্যে নারীদের ইস্যুটি আলোচনায় আসত খুব কম। তবে বড় একটি ঘটনা ঘটে ১৯৩৬ সালের মে মাসে, সামরিক অভ্যুত্থানের ঠিক আগ দিয়ে। মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার নৈরাজ্যবাদী নারীদের দু’টি ছোট গ্রুপ একীভূত হয়ে গঠন করে মুখেরেস লিবরেস (ফ্রি উইমেন) নামের একটি সংগঠন।

সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়া হিসাবেই স্পেনে বিপ্লব শুরু হয়েছিল। প্রধানত অ্যানার্কো-সিন্ডিকালিস্ট ইউনিয়ন, সিএনটি-র শ্রমিকরা এবং কিছু জায়গায় সোশ্যালিস্ট ইউনিয়ন ফেডারেশন, ইউজিটি-র শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসেন। সামরিক অভ্যুত্থান ঠেকানোর এই প্রতিক্রিয়া ছিল খুব স্বতঃস্ফূর্ত ও সাহসী। এর ওপর প্রবলভাবে ছিল নৈরাজ্যবাদী চিন্তাধারার প্রভাব, যেটি স্প্যানিশ শ্রমিক ও কৃষকদের মানসিকতায় গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

সামরিক ক্যু-এর বিরুদ্ধে প্রাথমিক এই প্রতিরোধ ও যুুদ্ধের সব জায়গাতেই সমানভাবে ছিলেন নারীরা। অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট মিলিশিয়ার অংশ হিসেবে তারা সামনের সারিতে লড়াই করেছেন পুরুষদের সঙ্গে। কিন্তু ১৯৩৬ সালের নভেম্বরে নারীদের ফ্রন্টলাইন থেকে সরে আসার নির্দেশ দেয় রিপাবলিকান সরকার। মাদ্রিদের যুদ্ধে অনেকে মারা যান। সেসময় নারীর কাজ, অবসর এবং নারীদের প্রতি মনোভাবে বেশ কিছু বড় পরিবর্তন আসে।

শিল্প ও জমি কালেক্টিভাইজেশনের ক্ষেত্রে নারীরা সর্বস্তরে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তারা ঘরের কাজ ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েন কলকারখানায় কাজের জন্য। তখন সময়টা ছিল বিপুল উত্তেজনা আর উৎসাহে ভরপুর। এবং এই বিপ্লবী উদ্যম ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো রিপাবলিকান অঞ্চলে। মুখেরেস লিবরেসের কাতালান আঞ্চলিক কমিটির সদস্য পেপেশিয়া কার্পেনা বলেছিলেন, “এমনকি আমি মরে গেলেও এমন অভিজ্ঞতা হাতছাড়া করতে চাইতাম না।”

বিপ্লব পরবর্তী সামাজিক পরিবর্তনগুলো বরাবরই বেশ নাটকীয় হয়! হাজার বছর ধরে পালিত নিয়ম কানুন, পুরানো প্রত্যাশা, স্বীকৃতি এবং আচরণের পদ্ধতিগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করে, তবে রাতারাতি পরিবর্তন আসে না কখনোই। পরিবর্তন শুরু হয় আলাপ-আলোচনা থেকে। প্রায়ই দেখা যায়: কিছু জিনিস আমূল পরিবর্তনের জন্য পাড়ি দিতে হয় অনেক দীর্ঘ ও বিশৃঙ্খল পদ্ধতির তর্ক-বিতর্ক, মতবিরোধের পথ। ফলে, স্পেনের ক্ষেত্রেও দেখা যায় বিপ্লবের জন্য সব কিছু প্রস্তুত করা ছিল না।

তেরেসার মত অঞ্চলে নৈরাজ্যবাদীরা সুসংগঠিত ছিল। সেখানকার টেক্সটাইল শিল্পে ১৯৩১ সাল থেকে নৈরাজ্যবাদী নারীদের একটি গ্রুপ ছিল। তারা মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং সমান বেতনের অধিকার অর্জন করেছিল। যদিও অনেক ক্ষেত্রে সিএনটি সম্পূর্ণ সমতার লক্ষ্য অর্জন করতে অক্ষম বা অনাগ্রহী ছিল। টেক্সটাইল শিল্পে, সাধারণত যেখানে কিনা নারীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্মশক্তি ছিলেন, সেখানেও তারা সবচে কম মজুরি পেতেন।

জমির ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি মনোভাব ছিল আরো অনগ্রসর। ফলে জমির কালেক্টিভাইজেশনের সময় নারীরা প্রথমবারের মতো আবিস্কার করে যে, তাদেরও সত্যিকার অর্থেই একটি কণ্ঠ আছে। যদিও তা সব সময় পুরুষদের তুলনায় সমান ছিল না। আরাগনের ম্যাজন ও মিরামেলের মত অনেক কালেক্টিভে নারীরা পুরুষদের সমান বেতন পেত। যদিও, সব জায়গায় চিত্রটি এমন ছিল না।

কিছু কালেক্টিভে এটা মানা হতো যে, নারীরা নিজের আয়ে চলার অধিকার রাখে। যেটি সেসময়ের জন্য একটি অগ্রগতি ছিল। যদিও অধিকাংশ কালেক্টিভে চালু ছিল ‘ফ্যামিলি ওয়েজ’ ব্যবস্থা। আর এটি অবশ্যই বেশিরভাগ সময় পরিবারের প্রধান হিসেবে পুরুষের হাতেই দেওয়া হতো। শ্রমের সামাজিক বিভাজন তখনও চালুই থাকে। নারীদের কাজগুলো ছিল ‘নারীদের কাজ’। আর নারীরা যখন ‘পুরুষদের কাজ’গুলোও করতেন, তখনও তারা পারিশ্রমিক পেতেন নারী হিসেবে!

অন্তত তাত্ত্বিকভাবে হলেও, নারী-পুরুষের সম্পূর্ণ সাম্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সিএনটি। ১৯৩৬ সালে সারাগোসা সম্মেলনে তারা ঘোষণা করেছিল যে, বিপ্লবের পর “অধিকার ও দায়দায়িত্বের ক্ষেত্রে উভয় লিঙ্গই সমান গুরুত্ব পাবে”। তবে বাস্তব চর্চার ক্ষেত্রে দেখা যায়, ১৯৩৬ সাল পর্যন্তও সিএনটি তাদের নারী কমরেডদের সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে নিত না। লিঙ্গ বৈষম্য ছিল সাধারণ ব্যাপার। এটি মোকাবিলার জন্যই ১৯৩৬ সালের মে মাসে গঠন করা হয় মুখেরেস লিবরেস

মুখেরেস লিবরেসের লক্ষ্য ছিলো নারীর ক্ষমতায়ন ও নৈরাজ্যবাদী রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণের আত্মবিশ্বাস গড়তে ভূমিকা রাখা। নিজস্ব মুক্তির সংগ্রামে প্রত্যেক নারীকে সরাসরি যুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা তারা অনুভব করেছিল। তারা নিজেদের ‘নারীবাদী’ বলে আখ্যায়িত করেনি কখনো; এমনকি এই সংগঠনের একজন সদস্য, সোলেদাদ এস্তোরাকের মতে, অনেকেই কখনো ‘নারীবাদ’ শব্দটিই শোনেননি! তাদের মতে, পুরুষ দ্বারা নারীর আধিপত্যের অবসান ঘটানো সকল প্রকার আধিপত্য বিলোপেরই একটা বিশেষ অংশ। তাদের বিশ্বাস ছিল: নারীর ওপর পুরুষের আধিপধ্যের অবসান ঘটানোর মাধ্যমে তারা অন্য ধরনের আধিপত্যেরও অবসান ঘটাতে পারবেন।

ব্যক্তি নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতার মতো সংকীর্ণ নারীবাদীতার বদলে, তাদের বিশ্বাস ছিল সামগ্রিকভাবে মুক্তি অর্জন। একই একই সঙ্গে ছিল নৈরাজ্য ও মুক্তি অর্জনের বৃহত্তর সংগ্রাম। তবে তাদের সংগ্রামের বড় একটি অংশ জুড়ে ছিল নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনের মধ্যে নারীর অবমূল্যায়ন রোধে কাজ করা।

মুখেরেস লিবরেসের কৃতিত্ব ও অর্জন:

মাত্র দুই বছরের মধ্যেই মুখেরেস লিবরেস-এর সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৩০ হাজারে। পুরো রিপাবলিকান স্পেন জুড়েই এই সংগঠনের অর্জন বিস্তর রূপ ধারণ করে। তাদের কর্মকাণ্ডের একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল: নারীশিক্ষা। ১৯৩৭ সালে বার্সেলোনায় তারা প্রতিষ্ঠা করেন নারীদের কলেজ, ‘কাসা দে লা দোনা’। ১৯৩৮-এর ডিসেম্বরের মধ্যেই এই কলেজে প্রতিদিনে ৬০০-৮০০ জন নারী যুক্ত হতে থাকে। বার্সেলোনা এবং মাদ্রিদের শিল্পক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তারা অসংখ্য স্কুল এবং কোর্স পরিচালনা করে। একই সাথে তারা কর্মক্ষেত্রেও নারী-পুুরুষের সমতার জন্য লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়েছিলেন।

তারা মাদ্রিদে একটি শ্যুটিং রেঞ্জ স্থাপনের মাধ্যমে সামরিক প্রশিক্ষণেও যুক্ত হয়েছিলেন। তেরেসা ও বার্সেলোনায় ম্যাটার্নিটি হাসপাতাল তৈরি ও নারী শিশুদের জন্য অসংখ্য স্কুল প্রতিষ্ঠাও তাদের বিশাল অর্জন। এই বিদ্যালয়গুলো নৈরাজ্যবাদী শিক্ষাব্যবস্থার ধারণার উপর ভিত্তি করে উন্নয়ন ও অন্বেষণে বিশ্বাস করতো।

মুখেরেস লিবরেস গর্ভপাত, গর্ভনিরোধ এবং বিবাহবিচ্ছেদের অধিকারের জন্য লড়াই করেছে, জয়লাভও করেছে। স্থানীয়ভাবে, কিছু সংখ্যক চাকুরীজীবি নারীর জন্য চাইল্ড কেয়ারের ব্যবস্থাও করেছিল তারা। যুদ্ধের বিস্তার বাড়ার সাথে সাথে অনেক সদস্য শরনার্থীদের আবাসন ও শিক্ষার জন্যও কাজ করেন।

সর্বোপরি, মুখেরেস লিবরেস তাদের নিজেদের সংগ্রামের মাধ্যমে নারী মুক্তির লক্ষ্যেই এগিয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধের অগ্রগতির সাথে সাথে সমাজতান্ত্রিক, কমিউনিস্ট এবং পিওইউএম (অ্যান্টি-স্টালিনিস্ট-লেনিনিস্ট) সবাই মিলিত হয়ে “নারী বিভাগ” স্থাপন করেছিল। সকলেই নারীদেরকে ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে এবং তাদের নিজস্ব সংস্থায় নিযুক্ত করতে চাইছিল, তবে কেউই প্রকৃতপক্ষে নারী মুক্তিকে নিজেদের সংগ্রামেরই একটি লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত করেনি, যা একমাত্র মুখেরেস লিবরেসই করেছিল।

স্পেনের নারীদের ভাগ্য সমগ্র বিপ্লবের সাথেই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল। তৎকালীন সরকার ও কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা সংগ্রাম স্থগিত হওয়ার কারণে নারীরাও পিছিয়ে পড়ে। সব মিলিশিয়া ও কালেক্টিভ ধ্বংসের সাথে সাথে তাদের ক্ষণস্থায়ী স্বাধীনতাও হনন করা হয়। ফ্রাঙ্কোর বিজয় এই হননের-প্রক্রিয়াকে কেবল পাকাপোক্ত করেছিল।

বিপ্লব যে নারীদের জন্য সত্যিকার অর্থে কিছু লাভ এনেছিল, তা নিশ্চিত। স্প্যানিশ বিপ্লবের ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট যে, বিপ্লবীরা নারী স্বাধীনতাকে উপেক্ষা বা অগ্রাহ্য করতে পারে নি। এই স্বাধীনতাকে বিপ্লব শেষ হওয়া পর্যন্ত কিংবা কেবল বিপ্লবের ‘নারী বিভাগ’ পর্যন্ত রেখে আসা যায়নি।

যেই লড়াই শুরু থেকেই সকলের জন্য স্বাধীনতা এবং সাম্য অর্জনের লক্ষ্য রাখে না, সেই লড়াই আর যাই হোক, বিপ্লব নয়।

________

রিদাকা জান্নাহ

রিদাকা জান্নাহ, একজন আনার্কা-ফেমিনিস্ট, উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। র‍্যাডিক্যালিস্ট বা লিবেরাল ফেমিনিজম, অরাজপন্থী, এনভায়রনমেন্টাল অ্যাকটিভিজম, এলজিবিটিকিউপ্লাসসহ সকল ধরনের স্বৈরাচার, আধিপত্য ও নিপিড়ন বিরোধী অ্যাকটিভিজমের সাথে তিনি জড়িত আছেন পারিবারিকভাবেই। পড়াশোনার পাশাপাশি লেখালেখি, পেইন্টিং এবং থিয়েটার করছেন।

https://www.auraj.net/spanish-biplober-mukta-narira/5695/

Laisser un commentaire

Votre adresse e-mail ne sera pas publiée. Les champs obligatoires sont indiqués avec *

%d blogueurs aiment cette page :